ঢাকা, শনিবার   ২৬ এপ্রিল ২০২৫

Ekushey Television Ltd.

লাশের মিছিলে আমাদের অপেক্ষা   

একুশে টেলিভিশন

প্রকাশিত : ২০:৪৭, ১৭ এপ্রিল ২০১৮ | আপডেট: ১৭:৩৩, ১৮ এপ্রিল ২০১৮

Ekushey Television Ltd.

মৃত্যু যেন এখন অনেক সহজ হয়ে গেছে। আমরা এখন কারো মৃত্যু দেখে বিচলিত হইনা। কারো মৃত্যুর খবর শুনে দাঁড়াবারও সময় কারো হয়ে ওঠে না। তবু কিছু কিছু মৃত্যু আমাদেরকে নাড়া দিয়ে যায়। আমরা প্রতিবাদমুখর হয়ে ওঠি। জ্বলে ওঠি। আমাদের ক্ষোভগুলো কয়লার আগুনের মতো জ্বলতে থাকে।

কিছু মৃত্যু আমাদের স্বাভাবিক জীবনের ছন্দপতন ঘটায়। চিন্তাশক্তিকে খানিকটা ধাক্কা দেয়। তেমনি আজ ধাক্কা পেলাম দুই বাসের চাপায় হাত হারানো স্বপ্নবাজ তরুণ রাজিবের মৃত্যুতে।    

হাসপাতালের বেড়ে ছটপট করতে করতে রাজিব চলে গেল না ফেরার দেশে। জানি, কেউ কোনো দিন আর জানতে চাইবে না, রাজিব কে? রাজিবের খোঁজও কেউ নেবে না। সে সময়ও কারো নেই। কিন্তু এভাবে কত রাজিব যে অকালে চলে যাচ্ছে তার খবরই বা কে রাখে।

দুটি বাসের চাপে হাত হারানো মৃত রাজীব অল্প কয়দিনে সবার পরিচিত হয়ে ওঠেছে। তাকে নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে যেমন ঝড় চলছে, তেমনি চাপা আগুন বিরাজ করছে আমাদের সবার মনে।

আমাদের সড়কে চলা যানবাহনগুলো যেন একেকটি মরণ ফাঁদ। এই ফাঁদে পড়ে কত মায়ের বুক যে খালি হয়েছে তার হিসেব নেই। কত মেধাবী মুখ যে রাজীবের মতো অকালে ঝরে গেছে তার হিসেব কে রাখে। কিন্তু এসবের মাঝে রাজিবের মৃত্যুটা ব্যতিক্রম। 

রাজীব পনের দিন মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই করেছে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সে জীবন-মৃত্যুর লড়াইয়ে হেরে গেছে। সোমবার রাত পৌনে একটায় নিথর হয়ে গেল তার দেহ। সাদা চাদরে ঢেকে যায় তার স্বপ্নগুলো।

রাজীবের মৃত্যুর সবচেয়ে বড় ট্র্যাজেডি ছিল, রাজীব নিজে দেখেছে তার হাত নিজের শরীর থেকে ছিঁড়ে যাচ্ছে। আলাদা হয়ে যাচ্ছে। এটা কতো বড় নির্মম ট্রাজেডি তা হয়তো ভুক্তভোগীই ভাল জানেন। এই ধাক্কা সামলানোর ক্ষমতা শেষ পর্যন্ত রাজীব নিতে পারেননি।

আমরা এ সমাজের সাধারণ নাগরিক। রাষ্ট্র নিম্ন মধ্যম আয়ের হলেও বা `উন্নয়নশীল` তকমা পেলেও আমরা অধিকাংশ মানুষ সকালে ঘুম থেকে ওঠে ভাবি, আজকের দিনটি আমাদের কেমন যাবে, কি খাব, কি করবো। অস্বীকার করার উপায় নেই রাজীব সেই সমাজের প্রতিনিধি মাত্র। দৃশ্যত রাজীব হাত হারিয়েছে। ধাক্কা সামলাতে না পেরে সে মারা গেছে। কিন্তু এটা কী সত্য নয়, আমরা দিন এনে দিন খাওয়া মানুষগুলো সবাই রাজীবের মতো এমন ঝুঁকিতে আছি।

‘সড়ক দূর্ঘটনা’ শব্দটি যতোই পরিচিত হোক না কেন, এটি অস্বীকার করার উপায় নেই সেই শব্দটি একটা অজুহাত মাত্র। এগুলো খুন। পরোক্ষ ভাবে মানুষ খুনের যতোগুলো বিষয় আছে তার মধ্যে আমরা স্বাভাবিক স্বীকৃতি দিয়ে রেখেছি এই খুনকে। হয়তো বুঝিনা। বা বুঝেও না বুঝার ভান করি।

মাঝে মাঝে এরকম কোনো কোনো খুন আলোচনায় আসে। হৈ চৈ হয়। আমরা মানববন্ধন করি, সভা সমাবেশ করি। তারপর অব্যবহৃত পুকুরের মতো শান্ত স্থির হয়ে যায় সব। কিন্তু এ সমস্যা ততোদিন মিটবে না, যতোদিন আমরা ভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করবো না।

দেশ স্বাধীন হয়েছে ৪৭ বছর। এই ৪৭ বছরেও আমাদের রাজনীতি বাস চালকদের ইউনিফর্ম পরাতে পারেনি। গাড়ির নির্দিষ্ট ভাড়া নির্ধারণ করতে পারেনি। যত্রতত্র যাত্রী উঠা নামা বন্ধ করতে পারেনি। চলন্ত অবস্থায় গাড়িতে উঠা নামা বন্ধ করতে পারেনি। মুখে `সিটিং সার্ভিস` বললেও গাদাগাদি করে লোক নেওয়া বন্ধ করতে পারেনি। চালকদের প্রশিক্ষণ ও বৈধ লাইসেন্স নিশ্চিত করতে পারেনি।

বাসের চালক, হেল্পারদের জন্য `পরিবহন শ্রমিক` তকমা লাগানো নানা ধরনের সংগঠন আছে। রাজনীতি আছে। ভোট আছে। ধর্মঘট আছে। কিন্তু আমি আমরা আমাদের জন্য কোনো সংগঠন নেই, রাজনীতি নেই। আমাদের ভোট নিয়েও কেউ চিন্তিত নয়। দু`মুঠো খাবারের সন্ধানে ব্যস্ত থাকা মানুগুলো আবার এসব আন্দোলন করবে কখন।

রাজীবদের জন্য কেউ নেই। কারণ, আমরা সবাই রাজীব। আমরা বড় জোর নিজ যোগ্যতায় (?) লাশ হতে পারি। এসো লাশ হই। আমরা অপেক্ষা করছি লাশের মিছিলে।

আআ/এসি

 


** লেখার মতামত লেখকের। একুশে টেলিভিশনের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে।
Ekushey Television Ltd.

© ২০২৫ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি